মুক্তিযুদ্ধে শৈলকুপা
গেরিলা আক্রমণ
গেরিলা আক্রমণ ভারতে ট্রেনিং প্রাপ্ত ঝিনাইদহ জেলার নওজোয়ানরা মুক্তিবাহিনীর নির্দেশ মত নিজেদের ভিতরে এবং তাদের দোসর রাজাকারদের সমূলে বিনাশ করতে থাকে । এ মন কয়েকটা প্রচন্ড গেরিলা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল শৈলকুপা উপজেলায়। উল্লেখযোগ্যগুলি হচ্ছে (১) শৈলকুপা থানা আক্রমণ (২) কামান্নার যুদ্ধ (৩) আবাইপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গনের যুদ্ধ (৪) আলফাপুরের যুদ্ধ। কামান্নার যুদ্ধে ২৭ জন এবং আবাইপুরে ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কামান্নার মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা নজরুল ইসলাম শহীদ হন। স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর কামান্নাতে নিহত ২৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ঝিনাইদহ শহরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। আলফাপুরে নেতৃত্ব দেন শৈলকুপা থানা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান মন্টু, আবু আহমেদ, সোনা মোল্লা এবং শ্রীপুরে আকবর চেয়ারম্যান। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর ২ জন ক্যাপ্টেন, ৩ জন সিপাহী এবং ৪ জন রাজাকার নিহত হয়। গেরিলাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। শহরের এবং গ্রাম-গঞ্জের অধিকাংশ লোক গেরিলাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করে স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করে তোলো।
কামান্না ২৭ শহীদের মাজার
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ শৈলকুপা ইতিহাস হয়ে আছে। ৫ এপ্রিল গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ, ৪ আগষ্ট আলফাপুরের যুদ্ধ, ১৩ অক্টোবর আবাইপুরের যুদ্ধ, ২৬ নভেম্বর কামান্নার যুদ্ধ এবং ৮ এপ্রিল, ৬ আগস্ট, ১৭ আগষ্ট ও ১১ নভেম্বর শৈলকুপা থানা আক্রমণের মাঝ দিয়েই শৈলকুপা শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিসেনারা উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা। শৈলকুপায় পাক-হানাদার ও তাদের সহযোগীরা চালিয়েছে নির্বিচারে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট। যার জলন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে কামান্না ও আবাইপুরের হত্যাযজ্ঞসহ আরো বেশ কিছু নারকীয় ঘটনা। কামান্না যুদ্ধ এসবের সর্বাধিক গুরুত্ববাহী।
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর ভোর রাতে কামান্না গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞে নিহত হন ২৭ জন বীর মুক্তিসেনা। আর আহত হন অর্ধশতাধিক গ্রামবাসী। চৌকশ ও সাহসী ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন শেষে ভারত থেকে কামান্নার মাধব চন্দ্রের বাড়িতে আশ্রয় নেন। মাগুরার শ্রীপুর, মাগুরা সদর ও শৈলকুপা উপজেলায় এঁদের বাড়ি। শৈলকুপার মালিথিয়া গ্রামের আলমগীর ও শ্রীপুরের আবুবকর ছিল এদের মধ্যে প্রধান।
মুক্তিযোদ্ধাদের এ উপস্থিতির সংবাদ স্থানীয় রাজাকারদের তৎপরতায় দ্রুত চলে যায় ঝিনাইদহ ও মাগুরার আর্মি ক্যাম্পে। হানাদারদরা ঝিনাইদহ ও মাগুরা থেকে ভারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাতের অন্ধকারে পৌছে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খুব কাছাকাছি। দুরে তাদের গাড়িগুলো রেখে পায়ে হেটে এগিয়ে এসে রাতের অন্ধকারে হঠাৎ করেই হানাদাররা মুক্তিসেনাদের আশ্রয়স্থল লক্ষ্য করে মর্টারের ভারী গোলা ছোড়ে। আকস্মিক এ আত্রমণে পথক্লান্ত মুক্তিসেনারা হকচকিয়ে যায়। সামলে নিয়ে শক্ত হাতে তুলে নেয় হাতিয়ার। প্রতিআক্রমণ চালায়। কিন্তু আকর্ষিক আক্রমণে মুক্তিসেনারা তাদের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। ঘরের মাঝে আটকা পড়ে যায় অনেকে। পাকসেনারা তাঁদেরকে গুলি ছুঁড়ে হত্যা হরে। তারা গ্রামটিকেও তছনছ করে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ফণিভূষণ কুন্ডু ও রঙ্গবিবিকে গুলি করে হত্যা করে। তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে অনেক গ্রামবাসীও আহত হয়। হানাদাররা স্থান ত্যাগ করার পর পরই আশে পাশের গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক এসে জড়ো হয়। ঘরের মেঝেয়, উঠানে, বাড়ির আঙিনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল মুক্তিসেনাদের ক্ষত বিক্ষত নিষ্পাপ দেহ। রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল বাড়িটির সারা আঙিনা। সববগুলো লাশ জড়ো করা হয় এক জায়গায়। কামান্না হাই স্কুলের খেলার মাঠের উত্তর পাশে কুমার নদ ঘেঁষে ৬ জন করে দুটি ও ৫ জন করে তিনটি গণকবরে এ ২৭ বীর শহীদের কবর ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে একটি শহীদ মিনার, যার গায়ে লেখা রয়েছে ২৭ শহীদের নামঃ
১।মোমিন ২। কাদের ৩। শহীদুল ৪।ছলেমান ৫। রাজ্জাক ৬। ওয়াহেদ ৭। রিয়াদ ৮। আলমগীর ৯। মতলেব ১০। আলী হোসেন ১১। শরীফুল ১২। আলীমুজ্জামান ১৩। আনিছুর ১৪। তাজুল ১৫। মনিরতজ্জামান ১৬। মমিন ১৭। রাজ্জাক ১৮। কওছার ১৯। ছলেমান ২০। আজিজ ২১। আবকর ২২। সেলিম ২৩। হোসেন ২৪। রাশেদ ২৫। গোলজার ২৬। অধীর ২৭। গৌর।
যেভাবে যেতে হবে ঃ ঝিনাইদহ হতে স্থানটির দুরত্ব ৩৫-৩৮ কিঃ মিঃ। ঝিনাইদহ হতে বাসযোগে সড়ক পথে গাড়াগঞ্জ । এরপর গাড়াগঞ্জ হতে বাসযোগে শৈলকুপা যেতে হবে। শৈলকুপা হতে বাস/ বেবীযোগে হাটফাজিণপুর যেতে হবে। সেখান থেকে পায়ে হেটে / ভ্যানযোগে কামান্না শহীদ মাজারে যেতে হবে।
শৈলকুপা গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল, কুষ্টিয়া থেকে যশোর সেনানিবাসে ফিরে যাবার পথে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বড়দা ব্রিজে অর্ধশতাধিক হানাদার পাকসেনার একটি দল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এতে চার জন স্থানীয় গ্রামবাসীসহ নিহত হয় ৪০ জন হানাদার পাকসেনা।
দেশব্যাপী উত্তাল অগ্নিঝরা মার্চ। ২৫ মার্চের “অপারেশন সার্চলাইট” এর হত্যাযজ্ঞের রাতে যশোর সেনা নিবাস থেকে ১ কোম্পানী সেনা সদস্য কুষ্টিয়া গিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ওয়ার্লেস টাওয়ার, জেলা হাইস্কুলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অবস্থান নেয়। জেলার প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী তদানীন্তন এস.ডি.পি.ও মাহবুব উদ্দিন আহমেদের নির্দেশে ২ এপ্রিল রাতে নৌবাহিনী প্রত্যাগত শৈলকুপার রহমত আলী মন্টু তার অন্যতম সহযোগী সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা আশরাফুল আলম ও নায়েব আলী জোয়ার্দ্দার শতাধিক সহযোগী সহ রাতে কুষ্টিয়ার পথে রওনা হয়ে যান।
এরই মধ্যে ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া মহাসড়কে-সেনাবাহিনীর টহল শুরু হয়ে গেছে।এমতাবস্থায় কুষ্টিয়াগামী আনসার ই, পি, আর ও জনতার দলটি হরিণারায়নপুর বাজারের একটি গুদাম ঘরে আশ্রয় নেয়। রাতে দলটি পুনরায় কুষ্টিয়ার পথে যাত্রা করে। ভোর রাতে কুষ্টিয়ার কমলাপুর গ্রামের এক হিন্দু জমিদারের দোতলা বাড়িতে গিয়ে পৌছে। সেখানে ই.পি.আর থেকে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে আসা অর্ধশতাধিক ই.পি.আর সদস্য আগেই আশ্রয় নিয়েছিলো। তারা মিলিত ভাবে ৩রা এপ্রিল কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এদিকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, কুমারখালী, দৌলতপুরের হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী জনতা কুষ্টিয়া এসে জড়ো হয়। শ্লোগান আর মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে উঠে কুষ্টিয়া শহর। কারো হাতে দা, কুড়াল, রামদা, ঢাল, ফলা, লাঠি কারো হাতে সাধারন রাইফেল, কেউবা খালি হাতে একাধিক দলে ভাগ হয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থানগুলো ঘিরে ফেলে।
গভীর রাতে গ্রেনেড চার্জ ও বোমা বিষ্ফোরন ঘটিয়ে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের বৈদ্যুতিক অবস্থা অকেজো করে দেওয়া হয়। সারা শহর অন্ধকারে ডুবে যায়, শুরু হয় দু পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়। রাতভর এবং ৪ঠা এপ্রিল দিনভর চলে থেমে থেমে গুলি বিনিময়। সন্ধার পর রাতে অন্ধকার শহরে পরিস্থিতি অনুকুলে নিতে পাক সেনারা বিভিন্ন স্থান থেকে কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে এসে মিলিত হয় এবং ৬টি গাড়ী করে যশোর সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়।
২ এপ্রিল রাত থেকেই জেলা প্রতিরোধ সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক মাহাবুব উদ্দিন আহমেদের নির্দেশে পালিয়ে আসা আননসার ইনষ্ট্রাকটর গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে কুষ্টিয়া- ঝিনাইদহ সড়কের শৈলকুপার বড়দাহ ব্রীজে প্রতিরোধ প্রস্তুতি চলতে থাকে। ব্রীজের দক্ষিন পাড়ে পাকা পিচের রাস্তা কেটে খনন করা হয় সুবিস্তৃত বিরাট গর্ত। পাক সেনাদের বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে গর্তের উপরে বিছিয়ে দেয়া হয় আলকাতরার প্রলেপ দেয়া চাটাই। দু‘পাশে খননকৃত বাঙ্কারে রাইফেল হাতবোমা ও গ্রেনেড নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে এক ডজনেরও বেশি আনসার ইপিআর সদস্য।
৪ এপ্রিল রাতে কুষ্টিয়ার দিক থেকে ছুটে আসা হানাদার পাকসেনাদের গাড়ীর হেড লাইটের তীব্র ঝলকানি আছড়ে পড়ে ব্রীজের উপর। পর মূহুর্তেই একটি গাড়ি পড়ে যায় কেটে রাখা গর্তে। অন্ধকারেই গাড়ি গুলো থেকে ফাকা গুলির আওয়াজ হয়। বাঙ্কার থেকেও পাল্টা জবাব দেওয়া হয়। এভাবে গুলি ও পাল্টা গুলি বিনিময় চলে প্রায় সারা রাত ধরে।
রাতের আঁধারে পাকসেনারা গাড়ি থেকে নেমে যশোর সেনানিবাশের দিকে পায়ে হেটে রওনা দেয়। ভোর হয়ে আসে, আশে পাশের গ্রামগুলো থেকে হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী জনতা যে যা কাছে পেয়েছে তাই নিয়ে মিছিলে জয় বাংলা শ্লোগানে চারিদিকে প্রকম্পিত করে বড়দা ব্রীজের দিকে ছুটে আসে।
জনতার রুদ্র রোষে ভীত সন্ত্রস্থ হানাদার পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে এবং পার্শ্ববর্তী বালাপাড়া, পোড়াহাটি, লক্ষনদিয়া গ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ২০ জন নিহত হয় এবং আতাউল্লাহ শাহ নামের একজন হানাদার ক্যাপ্টেন সহ বিভিন্ন স্থানে জনতার হাতে আটক হয় আরও প্রায় ২০ জন। এদেরকে গাড়াগঞ্জ বাজারের কুমার নদীর ঘাটে পিটিয়ে, কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এদিন হানাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে হান্নান আলী, বিশারত ও বাটলে মিয়া ও কাইসুর গ্রামের চার জন গ্রামবাসী নিহত হয়। পরদিন যশোর সেনানিবাস থেকে কয়েক প্লাটুন সেনা এসে মহেশপুর, বড়দা, শ্রীপুর, আনিপুর, চণ্ডিপুর, বাজুখালী ও রাণীনগরসহ বড়দা ব্রীজের আশপাশের আট-দশটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।
বীরাঙ্গনা রিজিয়া
ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লী রয়েড়া গ্রাম। ঝোপ-ঝাঁড়, এঁদো-ডোবার ধারে জীর্ণশীর্ণ স্যাতস্যাতে ছাপড়া ঘরে বীরাঙ্গনা রিজিয়ার সাজানো স্বপ্নের সংসার। সংসার বলতে পরনে ১১টি তালি দেওয়া সাদা বসন, মেঝেয় ছড়ানো-ছিটানো থালা-বাসন ও পানের বাটা, বোঁটকা গন্ধের ছেড়া, মলিন বিছানাপত্র আর এক পাশে ঝুলানো শিকায় লেপকাঁথা। ঘরের মাচায় শূন্য মাটির হাড়ি-পাতিল ও বারান্দার একদিকে রান্নার চুলা। এ বিধবার সংসারে মাঝে মধ্যে দুই মেয়ের চলাফেরা ছাড়া তেমন কিছু নেই। তবে আজকাল তাঁর স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতার টাকার পাওয়া গেলেও বীরাঙ্গনা রিজিয়ার কপালে আজও পাকসেনাদের এঁকে দেওয়া হিংস্র থাবার চিহ্ন ছাড়া এক শিশি মাথার তেল জোটেনি বলে তিনি জানান।